জানা গেছে, নিয়মানুযায়ী জেলেদের দিয়েই গঠন করা হয় মৎস্যজীবী সমিতি । হাওর-বাওরও ইজারা পান সমিতির সদস্যরাই। কাগজে-কলমে জেলার জলমহালগুলো মৎসজীবীরা সমিতির মাধ্যমে পেলেও পানিতে নেই তাই তাদের অধিকার। ওইসব জলমহাল পুরোটাই ভোগ করছে প্রত্যেক এলাকার প্রভাবশালী ওয়ার্টার লর্ডরা।
জলমহাল সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলেরা ইউএনবিকে বলেন, জলমহাল ইজারা নিতে লাখপতি বা কোটিপতি হতে হয়। প্রকৃত জেলেদের সেই সামর্থ্য নেই। তাই মৎসজীবী সমিতিতে এখন সম্পদশালীরা জেলে নয় এমন দালাল প্রকৃত লোকজনকে অন্তর্ভূক্ত করেছে। তাদের জেলে হিসেবে দেখিয়ে ইজারা নিয়ে ওয়াটার লর্ডরাই জলমহাল ভোগ করছে। তাই প্রকৃত জেলেদের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তাদের ভাগ্য বদলাচ্ছে না।
নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের অসতর্কতা ও তদারকির অভাবেই জলমহালগুলো এখন জেলেদের হাত থেকে কথিত মৎসজীবী প্রভাবশালীরা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানায় সাধারণ জেলেরা।
শাল্লা উপজেলার জলমহাল পাড়ের কনক বলেন, বাড়ির পাশে জলমহাল আছে, সমিতি আছে, ইজারাও পান তারা। কিন্তু তাদের মাছ ধরতে দেয়া হয় না। কারণ তাদের সমিতি বিকিয়ে দিয়েছেন ওয়াটার লর্ডদের কাছে।
জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়নের মো. কাচা মিয়া বলেন, বাড়ির সামনের হাওরেও জাল ফেলা যায় না। জাল ফেললেই ইজারাদারদের নিয়োজিত পাহারাদাররা জাল-নৌকা নিয়ে চলে যায়। যারা প্রকৃত মৎস্যজীবী তারা অর্থের অভাবে জলমহাল ইজারা আনতে পারে না। তাই বড় বড় মহাজনরা সমিতিতে অর্থলগ্নি করে। কাগজপত্রে জলমহালের মালিক মৎস্যজীবীরা থাকলেও তারা কোনো সুফল পায় না। লাভ চলে যায় অর্থলগ্নিকারী প্রভাবশালীদের পকেটে। তারা আমাদের নামে জলমহাল ইজারা আনেন। পরে নিরীহ জেলেদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে তারা বছরের পর বছর জলমহাল ভোগ করেন।
তাহিরপুর উপজেলার মানিগাঁও গ্রামের মো. মিয়া ধন বলেন, বিলের আকার আয়তন ও উৎপাদন ভেদে ডাক ওঠে কয়েক লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত। এতো টাকা বিনিয়োগ করে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা জলমহাল ইজারা আনতে পারে না। তাই তারা এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে নিজেদের ন্যায্য অধিকার বিকিয়ে দেয় সামান্য টাকার বিনিময়ে।
হটামারা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আজিজুর রহমান বলেন, সরকার জেলেদের হাওরে মাছ ধরার অধিকার শুধু কাগজেই দিয়েছে, পানিতে দেয়নি। কারণ, জলমহালের সীমানা চিহ্নিত না করায় বর্ষাকালে জেলেরা বাড়ির সামনেও জাল দিয়ে মাছ ধরতে পারে না। বিলের পাহারাদাররা তাদের জাল-নৌকা জোর করে নিয়ে যায়। পরে টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়।
বেশ কয়েকটি সমিতির সদস্যরা ইউএনবিকে বলেন, ইজারার মূল্য আয়ত্বে আনা হলেও মৎস্য আহরণ করা কোনো ভাবে সম্ভব হচ্ছে না। কারণ হিসেবে তারা বলেন, জলমহালের দিকে দৃষ্টি হাওর-বাওর এলাকার প্রভাবশালীদের। তারা ওয়াটার লর্ড হিসেবে পরিচিত। এদের বাইরে ইজারার কথা চিন্তাও করা যায় না। কেউ প্রতিবাদ করলেই হাওরে শুনা যায় গুলির শব্দ। হাওর এলাকায় জলমহাল নিয়ে বেশ ক’টি খুনের ঘটনার বর্ণনাও তুলে ধরেন সাধারণ জেলে ও সমিতির সদস্যরা।
এদিকে বদ্ধ জলমহাল ও উন্মুক্ত জলমহাল নিয়ে হাওরপাড়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিধিমালা অনুযায়ী উন্মুক্ত জলমহাল ইজারা দেয়ার বিধান নেই। তবুও উন্মুক্ত জলমহালকে বদ্ধ দেখিয়ে ইজারা চালু আছে এখানে। এরকম প্রথা চালু থাকায় প্রকৃত জেলেরা নামকাওয়াস্তে জেলে হিসেবে রয়ে গেছেন বলে জানান হাওর এলাকার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। পানিতে জেলেরা তাদের অধিকার ফিরে পাননি।
জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন, সরকারের কাছে মৎস্যজীবীরা হাওর ইজারার জন্য আবেদন করেন। তাদের আমরা হাওর ইজারা দেই। আজ পর্যন্ত কোনো মৎস্যজীবী কোনো অভিযোগ করেননি যে তারা কারও কাছে জিম্মি হয়ে হাওরে মাছ আহরণ করতে পারছেন না। আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ এলে আমরা বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বসহ বিবেচনা করবো।